আতিয়া মহল সেনা নিয়ন্ত্রণে ৪ জঙ্গির লাশ উদ্ধার

সিলেটের শিববাড়ি এলাকার আতিয়া মহল ঘিরে জঙ্গি বিরোধী সেনা অভিযানের তৃতীয় দিন গতকাল সোমবার ওই ভবনের নিচতলায় চারটি মরদেহ পাওয়া গেছে। এর মধ্য থেকে দু’টি মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশকে হস্তান্তর করা হয়েছে। গতকাল সন্ধ্যায় সিলেটে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে সেনাবাহিনী এসব তথ্য জানায়। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা অভিযান শেষ করেননি, পুরোপুরি শেষ হতে আরো কিছু সময় লাগবে। তবে ভেতরে আর কেউ জীবিত নেই। পুরো ভবনের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে কমান্ডোরা।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, ভেতরে যে নারীর লাশ পাওয়া গেছে তার নাম মর্জিনা ওরফে মঞ্জু আরা। তিনি জেএমবি নেতা ফাহিমের স্ত্রী। অন্য তিন জন হলেন মাঈনুল ইসলাম ওরফে মূসা, সোহেল ও রাফিদ আল হাসান। এদের মধ্যে সোহেল ও মর্জিনার পরিচয় নিশ্চিত করেছে গোয়েন্দা সূত্র। মূসা ও রাফিদের পরিচয় নিশ্চিত করা হয়নি। গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফখরুল আহসান বলেন, ‘নিচতলা থেকে চারটা মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। গোয়েন্দা তথ্য ছিল ওই ভবনের নিচ তলায় চারজন আছেন। এর মধ্য তিনজন পুরুষ এবং একজন নারী। আমরা দুটো মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেছি। বাকি দুটি মরদেহে আত্মঘাতী বেল্ট লাগানো আছে। ওই ভবনে যে পরিমাণ বিস্ফোরক আছে তাতে পুরো ভবন ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। তাই দেখে শুনে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে। যারা ভেতরে ছিল তারা অত্যন্ত প্রশিক্ষিত। এটা সেনাবাহিনীর বিশাল সফলতা। আমাদের অপারেশন চলমান আছে। ধারণা করা হচ্ছে ওই ভবনের নিচতলায় আর কেউ জীবিত নেই।’

এদিকে গতকাল সকালে নতুন করে গোলাগুলি শুরু হলে শিববাড়ীর আশপাশের বাসিন্দারা আবারো আতঙ্কিত হয়ে ওঠেন। গতকাল এক পর্যায়ে সেনা কমান্ডোরা আতিয়া মহলের দেয়াল ভেঙে ভেতরে ঢোকে।

শিববাড়ির বাতাসে বারুদের গন্ধ : শনিবার সকাল ৮টা ২৮ মিনিটে ‘অপারেশন টোয়ালাইট’ শুরুর পর থেকে থেমে থেমে চলেছে গুলিবর্ষণ ও বোমা বিস্ফোরণ। বারুদের গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে পুরো এলাকায়। স্থানীয়রা বলছেন, বাতাসে বারুদের গন্ধ ভেসে আসায় আমরা আতঙ্কে রয়েছি। মনে হয়, এই বুঝি গুলি ছুটে এলো। শিববাড়ি সংলগ্ন জৈনপুর এলাকার বাসিন্দা পোল্ট্রি ব্যবসায়ী আব্দুল খালিক (৬৫) বলেন, শুক্রবার ভোর থেকে আতিয়া মহল নামে উস্তার মিয়ার বাড়িটি ঘেরাও করে পুলিশ। পরদিন শনিবার সকাল থেকে গুলিবর্ষণ ও বোমা বিস্ফোরণের শব্দ। আতঙ্কে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে অন্য এলাকায় আত্মীয়ের বাড়িতে অবস্থান করছেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের সময়ও এভাবে গুলির শব্দ শোনেননি বলে মন্তব্য তার। আব্দুল খালিকের মতো এভাবে বাড়ি ছাড়া শিববাড়ি সংলগ্ন জৈনপুর, পশ্চিমপাড়া, কৈতপাড়া ও পাঠানপাড়া এলাকার বাসিন্দারা।

আতিয়া মহলে বিস্ফোরণ, কালো ধোঁয়া : আতিয়া মহলে গতকাল বিকাল সোয়া ৩টায় বড় ধরনের বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া গেছে। এরপর টানা কয়েক মিনিট ধরে আরও শব্দ শুনতে পাওয়া যায়। এর কিছুক্ষণ পরই কালো ধোঁয়া বের হতে শুরু করে ভবনটি থেকে। ফায়ার সার্ভিসকেও পানি দিতে দেখা গেছে সেখানে। ওই বস্ফািরণের পর আতিয়া মহলের বেশ কয়েকটি জানালা দিয়ে কালো ধোঁয়া বের হতে দেখা গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, ভেতরে কোথাও আগুন লেগে থাকতে পারে।

‘অপারেশন টোয়াইলাইটের’ ভিডিও প্রকাশ : ‘অপারেশন টোয়াইলাইট’ এর চতুর্থ দিনে দেয়াল ভেঙে আতিয়া মহলে প্রবেশ করছেন সেনা কমান্ডোরা। গতকাল সকাল থেকে থেমে থেমে গুলি ও বিস্ফোরণ চলার মধ্যেই দুপুরের পর দুইজন সেনা সদস্য সাংবাদিকদের জানান, তারা ইতোমধ্যে দুই পাশের দেয়াল ভেঙে ফেলেছেন। আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের ওয়েবসাইটে অভিযানের ভিডিও প্রকাশ করা হয়েছে, সেখানে প্যারা কমান্ডোদের হাতুড়ি ও কুড়াল দিয়ে দেয়াল ভাঙতে দেখা যায়।

আরো শিশু ও নারী উদ্ধার : গতকাল সকালে আতিয়া মহলের পাশে আজমল ভিলা থেকে আরো একজন নারীসহ ২ শিশু উদ্ধার করে নিয়ে আসে সেনাবাহিনীর সদস্যরা। অন্যদিকে গত তিন দিন সরকারি ছুটির পরও সোমবার সিলেট নগরীতে মানুষের চলা ফেরা ছিল অনেকটা নিয়ন্ত্রিত। বিভাগীয় এই শহরে অন্যান্য দিনের মত ভিড় ছিল না।

প্রবাসীরাও উদ্বিগ্ন: শনিবার সন্ধ্যায় আতিয়া মহলের পাশে পরপর বোমা বিষ্ফোরণের ঘটনায় দুই পুলিশ কর্মকর্তা ও অর্ধশত লোক আহত হওয়ার পর দেশের বিভিন্ন প্রান্ত ও বিদেশ থেকে স্বজনরা সিলেটে থাকা বাসিন্দাদের খোঁজ খবর নিচ্ছেন। প্রবাসে থাকা স্বজন উদ্বেগের সাথে সময় পর করছেন এবং সাবধানে থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন। তারাও জঙ্গি দমন অভিযানের সফল পরিসমাপ্তির অপেক্ষায়।

কে সেই ফারুক : শনিবার সন্ধ্যায় শিবাবাড়ির আতিয়া মহলের পাশে বস্ফািরেণে আহত হয়েছিলেন ফারুক নামের এক ব্যক্তি। আহত অবস্থায় ওসমানী হাসপাতালে তাকে ভর্তি করা হয়। কিন্তু ভর্তি হওয়ার কিছুক্ষণ পর থেকেই তিনি উধাও। তাকে খোঁজা হচ্ছে। ওই হামলার ব্যাপারে তাকে প্রাথমিক সন্দেহে রাখছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

হতাহতদের সম্পর্কে খোঁজ নিচ্ছে পুলিশ : আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সন্দেহে আছেন আহত হয়ে ওসমানী হাসপাতালে ভর্তি থাকা কয়েকজন। নিহতদের মধ্যে দু’জন। তাই নিহত চারজনের লাশ রবিবার দুপুরে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হলেও দু’জনের লাশ হস্তান্তর করা হয়নি।

শনিবার সন্ধ্যায় বোমা বিস্ফোরণে নিহত হন জালালাবাদ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মনিরুল ইসলাম, আদালত পুলিশের পরিদর্শক চৌধুরী মো. আবু কয়ছর, ছাত্রলীগ নেতা জান্নাতুল ফাহমি ও অহিদুল ইসলাম অপু, ছাতকের দয়ারবাজার এলাকার কাদিম শাহ এবং নগরীর দাঁড়িয়াপাড়ার শহীদুল ইসলাম। এদের মধ্যে কাদিম শাহ ও শহীদুল ইসলামের মরদেহ রবিবার পরিবারের কাছে হস্তান্তর করেনি পুলিশ। তাঁরা দু’জন পরস্পরের বন্ধু এবং দু’জনই নগরীর দাড়িয়াপাড়ায় প্রাইম লাইটিং এন্ড ডেকোরেটর্সে কাজ করতেন বলে জানা গেছে।

সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার এসএম রোকন উদ্দিন বলেন, ‘দু’জনের লাশ হস্তান্তর করা হয়নি। তাদের ব্যাপারে একটু খোঁজ খবরে প্রয়োজন রয়েছে। তাদের পরিবারের সাথে আমরা আলাপের পর ব্যবস্থা নেয়া হবে।’ তিনি বলেন, কারা হামলার সাথে জড়িত তা খুঁজে বের করতে তদন্ত চলছে। ঘটনায় যারা আহত হয়েছেন তাদের ব্যাপারেও খোঁজ খবর নেওয়া হচ্ছে। ওই বিস্ফোরণে ছয়জন নিহতের পাশাপাশি অন্তত ৫০ জন জন আহত হন।

সবজির বেগে বোমা! : এই হামলা আত্মঘাতি কী না এ ব্যাপারেও পুলিশ খোঁজ নিচ্ছে। প্রথমদফায় বোমা হামলাকারী জঙ্গি সবজির ব্যাগে করে বোমা বহন করে বিস্ফোরণ ঘটায় বলে ধারণা করছে পুলিশসহ উপস্থিত কারো কারো ধারণা। সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ কমিশনার (গণমাধ্যম) জেদান আল মুসা বলেন, বোমা বিস্ফোরণ স্থলের পাশে বাজারের ব্যাগ ও সবজি পড়ে থাকতে দেখে প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে হামলাকারী সবজির ব্যাগে করে বোমা বহন করেছিল।

বোমা হামলার ঘটনায় থানায় মামলা : শিববাড়ির জঙ্গি আস্তানা আতিয়া মহলের অদূরে পৃথক দুটি বোমা হামলা ও নিহতের ঘটনায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে গতকাল মামলা দায়ের করা হয়েছে। মোগলাবাজার থানার ওসি খাইরুল ফজল জানান, অজ্ঞাতপরিচয় আসামি দেখিয়ে থানার উপপরিদর্শক (এসআই) শিপলু চৌধুরী বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন। মামলায় ছয়জন নিহত ও ৩০-৩৫ জনকে আহত দেখানো হয়েছে।

বিস্ফোরক বিষয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের জন্য বোমাই হলো কাল: হাসপাতাল বেডে চিকিত্সাধীন দক্ষিণ সুরমা থানার আহত ওসি হারুনুর রশীদ গতকাল জানান, যখন শিববাড়ীতে অভিযান চলছিল তখন আমি বোমা-হামলা স্থলের অদূরেই ডিউটিরত ছিলাম। হঠাত্ বিকট শব্ধ শুনে দ্রুত সেখানে যাই। গিয়ে দেখি বেশ কয়েকজন মাঠিতে পড়ে কাতরাচ্ছে। দ্রুত তাদেরকে উদ্ধার করে গাড়ীতে করে হাসপাতালে পাঠাই। তখন এসবির আবু কয়সর ও ওসি মনিরুলসহ কয়েকজন বিস্ফোরিত স্থানটিকে ক্রাইম সিনের ফিতা দিয়ে বেষ্টনি দিয়ে অবিষ্ফোরিত এক বোমার দিকে নজর দেন। তখনই সেটি বিষ্ফোরিত হয়। সেই বোমাই কেড়ে নিল তাদের প্রাণ। কয়সর ও মনিরুল দু‘জনই বিষ্ফোরক বিষয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। ওসি হারুন বলেন, ‘আমি সামান্য দূরে থাকায় আল্লার রহমতে বেঁচে আছি। আমার হাতে ও উরুতে স্প্লিন্টারের আঘাত রয়েছে।’

গতকাল সোমবার ‘দীর্ঘ অভিযান, দেশ জুড়ে উত্কণ্ঠা’ এক স্থানে জঙ্গিদের অজ্ঞান করতে ‘চেতনানাশক’ ব্যবহার করা হয়েছে বলে লেখা হয়েছে। আসলে চেতনানাশক নয়, ব্যবহার করা হয়েছে ‘কাঁদানে গ্যাস’। ইত্তেফাক

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর